আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস পালন


শুক্রবার, ২৬ জুন ২০১৫ - শুক্রবার, ২৬ জুন ২০১৫

সুপ্রিয় দেশবাসী
আসসালামু আলাইকুম। ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮৮ সাল থেকে পৃথিবীব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে যুবসমাজ ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং সরকারের প্রতি আহ্বান পৌঁছে দিতে দেশের শতভাগ মাদকমুক্ত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির চলতি বছরের এই দিবসকে যথাযথভাবে পালনের জন্য বেশ কিছু কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, র‍্যালী, মানববন্ধন, ব্লাড ডোনেশন প্রভৃতি তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের এসব কর্মসূচী বাংলাদেশের তরুণ-যুবসমাজ এবং সংশ্লিষ্ট মহলের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে সেটা হবে আমাদের স্বার্থকতা।

সুপ্রিয় দেশবাসী!
অযুত সম্ভাবনার দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। এদেশের প্রায় সতের কোটি জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে তা আমাদের সম্ভাবনাকে আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০১৪ অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা চার কোটি ৭৬ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ এবং বিশ্বে তরুণ জনসংখ্যার দিক দিয়ে ৬ষ্ঠ। বাংলাদেশে প্রতি তিনজন মানুষের দুজনই উপার্জন করে। এই অবস্থা আরও ৩০ বছর চলবে। জাতীয় পরিস্যংখ্যান ব্যুরো ২০১২ ও সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক ২০১৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩৪ বছরের কম বয়সী তরুণ-যুবসমাজের সদস্য সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ; যে চিত্র পৃথিবীতে খুব বিরল। প্রায় প্রতি ৭০ থেকে ১২০ বছরে একবার করে একটি দেশে এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট দেখা যায়। এরকম ডেমোগ্রাফিক অবস্থায় যুবশক্তিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশই নিজেদেরকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। আর যারা এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে তারা উন্নয়ন করতে পারেনি। আমাদের বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে সে সুযোগ এসেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ যুবসমাজকে ধ্বংস করার জন্য নানামূখী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে আজ যুবসমাজের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে মাদকের মরণ ছোবল ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যা যুবসমাজকে শুধু অকেজোই করে দিচ্ছেনা বরং পরিবার থেকে শুরু করে গোটা সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে অশান্তির বিষবাষ্প। বিপুল সম্ভাবনার আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং এদেশের ভবিষ্যত কর্নধার যুবসমাজকে আমরা চোখের সামনে মাদকের কালো থাবায় ধ্বংস হতে দিতে পারিনা।

প্রিয় সচেতন নাগরিকসমাজ
মাদকের কাজ মাদকতা আর এর ফল নেশাগ্রস্থতা। একবার যে মাদকাসক্তিকে প্রশ্রয় দেয় ক্রমান্বয়ে সে মাদকের দাস হয়ে পড়ে এবং ক্রমবর্ধমান নেশা তাকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেয়না। মাদক মানুষের মেধা ও মননকে নষ্ট কর দেয়। মাদক মানুষকে দানবে পরিণত করে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি দ্বারা বহু অপরাধ ও অঘটন ঘটতে পারে। হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাস সহ বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয়জনিত অপরাধের একটি বড় অংশ মাদকাসক্তির প্রত্যক্ষ কুফল। মাদক সেবনকারী একজন ব্যক্তির কাছে তার জন্মদাতা বাবা ও মা নিরাপদ নন। জগতের কোনো মানুষই তার কাছে নিরাপদ নয়। সে উন্মত্ততার বশে যে কোনো মারাত্মক অপকর্ম করতে পারে। মদ, এলকোহল, হেরোইন, ফেন্সিডিল, গাঁজা, ভাঙ, পেথিডিন, টাকিলা, মারিজুয়ানা, আফিম, তামাক, কোকেন, ক্যাফিন, মরফিনসহ কিছু ঘুমের পিল (Tranquilizer, Seduxene, Enoctine, Phenergan, Stemetil, Laxatine) জাতীয় নানাবিধ মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি সম্প্রতি মাদকসেবীদের নেশায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে অতি উচ্চ মাত্রার আরেকটি মাদক ‘ইয়াবা’। এসব মাদক থেকে সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে রক্ষা করতে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

প্রিয় ছাত্র-ছাত্রী ভাই ও বোনেরা
বাংলাদেশ মাদক পাচারের রুট “গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল” ও “গোল্ডেন ক্রিসেন্ট” এর মাঝখানে অবস্থিত এবং এশিয়ার প্রধান প্রধান মাদক উৎপাদনকারী দেশসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত। ফলে মাদক পাচারকারীরা এদেশ ও এদেশের অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে তাদের ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রমকে কি ব্যর্থতা হিসাবে ব্যাখ্যা করা হবে নাকি সহযোগিতা হিসাবে আখ্যা দেয়া হবে- সেটা সচেতন মহলের কাছে বিরাট একটি প্রশ্ন! এছাড়াও বাংলাদেশ জাতিসংঘ প্রণীত বেশ কিছু আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সাক্ষর করেছে যার মধ্যে ১৯৬১ সালের Single Convention on Narcotic Drugs, ১৯৭১ সালের Convention on Psychotropic Substances এবং ১৯৮৮ সালের United Nations Convention Against Illicit Traffic in Narcotic Drugs and Psychotropic Substances উল্লেখযোগ্য। এসব কনভেনশনে মাদকদ্রব্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ক্রয়, বিক্রয় এবং পাচার ইত্যাদি নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও (আর্টিকেল ৩৬, বর্ণিত ‘সিঙ্গেল কনভেনশন ১৯৬১' দ্রষ্টব্য) এদেশের সীমান্ত ও পাহাড়ি এলাকায় আফিম আর শণের মত মাদকদ্রব্য চাষ হয়। তামাক ক্ষেতের অভ্যন্তরে পপি চাষের ঘটনাও এদেশে ধরা পড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এর ভূমিকা এক্ষেত্রে কোন চোখে দেখা যেতে পারে!! আবার একদিকে সরকারীভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কার্যকর রেখে অন্যদিকে বিদেশী মদ এবং বিভিন্ন নেশাদ্রব্য আমদানীর আইনি বা বেআইনি সুযোগ-শিথিলতা রাখা, বিভিন্ন শহরে মদের বার এবং বিশেষ শ্রেণীকে ব্যক্তিগতভাবে মদ খাওয়ার লাইসেন্স দেয়া রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের হিপোক্রেটিক চেহারা প্রকাশ করে যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক।

সচেতন অভিভাবক সমাজ
আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তরুণ বা যুবক বয়সের ছেলে-মেয়েরা মাদকের জগতে পা বাড়ায় ছোট ছোট নেশার মাধ্যমে। বিশেষ করে অসৎ সঙ্গের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তারা এ কাজ শুরু করে। যা প্রথমদিকে পিতা-মাতা খুব একটা আমলে না নিলেও পরবর্তীতে ঠিকই তাদেরকে পস্তাতে হয়; প্রিয় সন্তান আশির্বাদের পরিবর্তে পরিনত হয় অভিশাপে। অথচ ছোটবেলা থেকে সন্তানদেরকে সতর্ক করা এবং নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে পিতামাতা তাদের সন্তানদের মধ্যে প্রতিষেধক তৈরি করে দিতে পারেন পূর্বেই। নিয়মিত সচেতন অভিভাবকত্বের মধ্য দিয়ে স্নেহের পরশে ঠিক পথে পরিচালিত হবার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারেন সন্তানদেরকে।

দেশের পরিচালক সমাজ
তাকওয়া ও ইসলামী শিক্ষা মানুষকে মাদক থেকে বাঁচানোর জন্য বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ পবিত্র কুরআনে মাদক-সেবনকে শয়তানের কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং মদ-জুয়াসহ যাবতীয় নেশা-উদ্দীপক জিনিস হারাম ঘোষণা করা হয়েছে (সূরা আল মায়েদাহ : ৯০)। ইসলাম মাদক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে নির্মূল করতে চায়। ইসলামে মাদকের ‘নিয়ন্ত্রিত অনুমতি’র কোন সুযোগ নেই। ইসলামের নির্বাহী ও বিচারিক সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবে আল্লাহ্‌র রাসুল (সঃ) কুরআনের জারি করা ডিক্রিকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। একসময়ের তুখোড় মদ্যপ আরব জাতিকে সফলভাবে মাদকমুক্ত করে ছেড়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- “নেশা জাতীয় যে কোনো দ্রব্যই মাদক এবং সব প্রকার মাদকই হারাম” (সহীহ মুসলিম)। তিনি আল্লাহ্‌র অভিসম্পাত ঘোষণা করেছেন- মদ, মদ্যপায়ী, মদ পরিবেশনকারী, মদ বিক্রেতা, মদ ক্রেতা, মদ প্রস্তুতকারী, মদ পরিশোধনকারী, মদের ব্যবস্থাপক, মদ পরিবহণকারী এবং মদ যার জন্য পরিবহণ করা হয় তার উপর। ‘মদ’ বলতে এখানে যাবতীয় নেশাব্যঞ্জক দ্রব্যকে বুঝানো হয়েছে। ইসলামের হালাল-হারামের অন্যতম দর্শন হচ্ছে ইসলাম বান্দাহর জন্য পবিত্র ও উপকারী দ্রব্য হালাল করে এবং নিকৃষ্ট ও অপকারী দ্রব্য হারাম করে। তাই ইসলামে তথাকথিত “Soft Drug” এর কোন স্থান নেই। মাদকসেবন ও নেশা করা ইসলামী দণ্ডবিধিতে একটি ফৌজদারি অপরাধ এবং এর শাস্তি আশি দোররা বেত্রাঘাতের সমান। অতএব, মাদক থেকে বাঁচতে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। একই সাথে দেশবাসীকে বাঁচাতে সরকারের পক্ষ থেকে সব পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষা প্রণয়ণ এবং ইসলামী আইন তৈরিও একটি জরুরী চাহিদা। আমরা যত দ্রুত এ বিষয় অনুধাবন করতে পারব, আমাদের জন্য ততই কল্যান।

সুপ্রিয় যুবসমাজ
আমাদের প্রত্যেকের জীবন এবং সুস্থতা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিরাট একটি নেয়ামত। এ নেয়ামতকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে দুনিয়াটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলা এবং পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা চাইলেই একটি সুন্দর দেশ গড়তে, একটি সুন্দর সমাজ গড়তে, একটি শান্তিময় পৃথিবী গড়তে আমাদের যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারি। মাদকের মরীচিকাময় হাতছানির দ্বারা সে সুযোগকে নষ্ট করে দেয়া কোনভাবেই সমীচীন হতে পারেনা। আসুন, আল্লাহকে ভয় করি, ইসলামী অনুশাসন মেনে চলি, মাদকসহ সকল প্রকার পাপাচার থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে সুন্দর একটি সমাজ গড়তে অবদান রাখি। দেখবেন, ইনশা-আল্লাহ একদিন আমাদের হাতেই তৈরি হবে সুখী, সুন্দর আর সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।


এই জাতি বিধ্বংসী মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আগামী ২৬জুন-২০১৫ আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবসে কেন্দ্রীয় সংগঠন নিম্নলিখিত কর্মসূচি ঘোষণা করেছেঃ

# কর্মসূচী সমূহ :
=> মাদক বিরোধী মানববন্ধন (ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড)
=> “মাদকমুক্ত সমাজ আমাদের করণীয়” শীর্ষক আলোচনা সভা
=> মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশব্যাপী মাদক বিরোধী লিফলেট বিতরণ
=> স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক বিরোধী প্রচারণা কার্যক্রম
=> জাতীয় ও স্থানীয় (শাখা, থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন) পর্যায়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে পরামর্শ ও মতবিনিময় সভার আয়োজন
=> অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাদক বিরোধী পরামর্শ ও মতবিনিময় সভার আয়োজন
=> ২৬ জুন জুমাবার মসজিদে মসজিদে মাদকবিরোধী আলোচনা করার জন্য ঈমামদের নিকট লিফলেট পৌঁছানো এবং পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে নামাজ শেষে লিফলেট বিতরণ
=> স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের নিয়ে মাদক বিরোধী আলোচনা সভা


সংশ্লিষ্ট