শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী

৩০ নভেম্বর -০০০১ - ০৭ এপ্রিল ১৯৮৮ | ২১

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

চট্টগ্রামের কাটিরহাট, সন্ত্রাসবাদী ছাত্রলীগের কিলিং স্পট হিসেবে কুখ্যাত। এখানেই ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল শাহাদাতবরণ করেন শিবিরকর্মী নাসিম উদ্দিন চৌধুরী। চট্টগ্রাম কলেজে নিজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেখে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর আর বাড়ি ফেরা হলো না, সন্ত্রাসীদের আঘাতে শহীদ হয়ে চিরতরে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

ঘটনার প্রেক্ষাপট
চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজে সেসময় মুজিববাদী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের তাণ্ডব ছিল বেশ। তার মধ্যেও মানুষের মুক্তি আর অধিকারের কথা সাহসের সাথে বলে যাচ্ছিলেন ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। আন্দোলনের পথে, শান্তির লক্ষ্যে সাহসী মিছিলে নির্যাতন আর শাহাদাত আসবেই, সেটা শিবিরকর্মীরা জানতেন। এমনই এক মিছিল ছিল ১৯৮৮ সালের ৬ এপ্রিল। জোহরের নামাজের বিরতির সময় শিবিরকর্মীরা কলেজ ক্যাম্পাসে সুশৃঙ্খল মিছিল শুরু করে। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে মুখরিত মিছিলে নজরে পড়ার মতো বিষয় দাঁড়ালো এই যে, বিপুলসংখ্যক নতুন ছাত্র যোগ দিয়েছিল মিছিলে। তাতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের রাজ্যে এমন মুক্তিকামী মিছিল দেখে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের মনে শিবির সম্পর্কে নতুন আশার সঞ্চার হয়।

কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রাসীরা সেটি মেনে নিতে পারেনি। মিছিল যখন কলেজ শহীদ মিনারের পাদদেশে আসে ঠিক তখনি সমাবেশের ওপর ছাত্রলীগের (সু-র) কর্মীরা হাতবোমা নিক্ষেপ করে। সেই সাথে এলোপাথাড়ি গুলি করতে শুরু করে। ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ হন শিবিরকর্মী দিদারুল আলম ও সেলিমসহ আরো অনেকে। গুলি করতে করতে এক পর্যায়ে তারা শিবিরকর্মীদের কলেজের বাইরে নিয়ে যায়। পরে শিবিরকর্মী ও বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিরোধে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় বহিরাগত যুবক আমিনুল করিমসহ আরো কয়েকজন আহত হন। পুলিশ তাদের ফেলে যাওয়া একটি পাইপগান উদ্ধার করে।

শাহাদাতবরণ
নাজিরহাট কলেজ থেকে শান্তিকামী ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস থেকে পালাতে বাধ্য হয়। পরে তাদের বড় আস্তানা কাটিরহাটে একত্রিত হয়। পরদিন ৭ এপ্রিল কাটিরহাটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা, অস্ত্রের মুখে বাস-কোস্টার থামিয়ে তল্লাশি চালাতে থাকে শিবিরকর্মীদের সন্ধানে। নাসিম উদ্দিন এ খবর জানতেন না। তখন তিনি চট্টগ্রাম কলেজে সদ্য প্রকাশিত ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দেখে বাড়ি ফেরার পথে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গাড়ি থামিয়ে দেখতে পায় নাসিম উদ্দিনকে। ভীত-সন্ত্রস্ত যাত্রীদের ভিড় থেকে তারা নামিয়ে আনে নাসিমকে।

সেক্যুলার রাজনীতির ধ্বজাধারী সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের কর্মীরা রড, ছুরি ও কিরিচের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে তাঁর দেহ। স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় নাসিমের সারা দেহ। কিরিচের আঘাতে তাঁর মাথা ও হাতে গুরুতর জখম করে। এক পর্যায়ে তাঁকে মৃত ভেবে পাশের বিলে ফেলে সন্ত্রাসীরা চলে যায়। এখানে তিন ঘণ্টা তিনি পড়ে থাকেন। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা স্থান ত্যাগ করার পর স্থানীয় লোকজন তাঁকে পার্শ্ববর্তী ফটিকছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখা দিলে তাঁর চাচাতো ভাই ৪ নম্বর ভূজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাস্টার রজি আহমদ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরও তাঁর দেহ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। কিন্তু তিনি পুরোটা সময় মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্কেও সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন অস্ফুট কণ্ঠে, কালেমায়ে শাহদাত তাঁর মুখে ছিল পুরোটা সময়। শিবিরকর্মীরা তাদের মুমূর্ষু ভাইটিকে রক্ষা করতে, রক্ত দান করতে ছুটে আসতে লাগল। তাঁর চাচাতো ভাই মাস্টার রজি আহমদ যখন রক্তের জন্য ছোটাছুটি করতে লাগলেন, তখন নাসিম বলে ওঠেন, ‘আমার আর রক্তের প্রয়োজন নেই, আমি চলে যাচ্ছি রবের নিকট।’ একথা শুনে হাসপাতালে পড়ে যায় কান্নার রোল। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও বাঁচানো গেল না তাঁকে। বিকেল পৌনে পাঁচটায় ডাক্তাররা ঘোষণা করলেন নাসিম উদ্দিন আর নেই। সকলের সামনেই নাসিম উদ্দিন চলে গেলেন খুনরাঙা পথ বেয়ে জান্নাতের সর্বোত্তম ঠিকানায়।

জানাজা ও দাফন
শাহাদাতের খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র । সন্ত্রাসীদের হামলা শিবিরকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয় সারাদেশ। পরদিন ৮ এপ্রিল শহীদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম মহসিন কলেজ মাঠে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ছুটে আসে শহীদের জানাজায় অংশ নিতে। শহীদের লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তাঁর গ্রামের বাড়িতে। লাশ যখন নাজিরহাটে পৌঁছে তখন ঘিরে ধরে অপেক্ষমাণ হাজার ছাত্র-জনতা। সেখানে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় আবার। শোকার্ত মানুষের ঢল পেছনে ফেলে লাশ যখন ফটিকছড়িতে পৌঁছে সেখানে অবতারণা হয় আরেক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের।

এখানে অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর কলেজের অধ্যক্ষ, সহপাঠীবৃন্দ, ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। প্রিয় ছাত্রের স্মরণে বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন অধ্যক্ষ। কলেজমাঠে আরেকবার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে গ্রামের বাড়িতে অপেক্ষমাণ শোকে বিহ্বল আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহীরা শেষবারের মত জানাজায় মিলিত হন সেখানে। তাঁর কফিন যখন গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন কফিনের পেছনে ছুটছিল স্বতঃস্ফূর্ত শোকার্ত জনতার ঢল। তাঁকে ফটিকছড়ির পূর্ব ভূজপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়ির মসজিদস্থ পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়।

মায়ের প্রত্যাশা
‘নাসিম উদ্দিন সত্যবাদী ছিলেন। সত্য পথে চলার কারণে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আমার সন্তানকে শহীদ করেছে। হিংসার বশবর্তী হওয়ায় পুত্রকে হত্যা করে শিবিরের পথ চলা এই এলাকায় বন্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি, হবেও না। শহীদের মা হিসেবে শিবিরের প্রতি আমার অনুরোধ, অন্যায় শক্তির প্রতি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুন। আমার সন্তান চলে গেছে, এখন সব শিবিরকর্মীই আমার সন্তান।’

শহীদের স্মরণীয় বাণী
“মানুষের সেবা করব এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠায় শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।”

একনজরে শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী
নাম : নাসিম উদ্দিন চৌধুরী
মায়ের নাম : দেলোয়ারা বেগম
বাবার নাম : ডা: আহমদ হোসেন চৌধুরী
স্থায়ী ঠিকানা : চৌধুরী পাড়া, পোস্ট- কাজিরহাট, পূর্ব ভূজপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম
পরিবারের মোট সদস্য : ৯ জন
ভাই-বোন : ৫ ভাই, ২ বোন
ভাই-বোনদের মাঝে অবস্থান : দ্বিতীয়
সর্বশেষ পড়াশোনা : অনার্স ভর্তি পরীক্ষার্থী (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
সাংগঠনিক মান : কর্মী
জীবনের লক্ষ্য : শিক্ষকতা
আহত হওয়ার স্থান : কাটিরহাট বাজার
আঘাতের ধরন : রড, ছুরি, কিরিচ ও গুলি
যাদের আঘাতে শহীদ : ছাত্রলীগ
শাহাদাতের তারিখ : ৭ এপ্রিল, ১৯৮৮, ৪টা ৪০ মিনিট
শাহাদাতের স্থান : চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী

পিতা

ডাঃ আহমদ হোসেন চৌধুরী

মাতা

দেলোয়ারা বেগম

জন্ম তারিখ

নভেম্বর ৩০, -০০০১

ভাই বোন

৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে ২য়

স্থায়ী ঠিকানা

চৌধুরী পাড়া, কাটিরহাট, পূর্ব ভুজপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

অনার্স ভর্তি পরিক্ষার্থী

শাহাদাতের স্থান

কাটিরহাট বাজারে আহত হন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শাহদাতবরণ করেন।


শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী


শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী

ছবি অ্যালবাম: শহীদ নাসিম উদ্দিন চৌধুরী